ফুলদানি (রূপক)
-সুজিত চ্যাটার্জি
বৌমা, এ-ই নাও ধরো। বৌমা একটু ইতস্ততভাবে হাত বাড়িয়ে ধরলেন, সন্তর্পণে।
-যত্ন করে রেখেছিলাম এদ্দিন। এবার তোমার হাতে তুলে দিলাম। না না, মনে কোনও কিন্তু রেখো না। বিশ্বাস.. বুঝলে, আস্থা, একশো আনা আছে তোমার ওপর। তাইতো তোমার হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলাম। নইলে, আমার কী দেবার লোকের অভাব, নাকি নেবার লোকের।
শাশুড়ির পরম দান হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চোখ বুলিয়ে বৌমা ভাবলেন, একে রাখি কোথায় ? নিরাপত্তার কারণে যেখানে সেখানে, যা হোক তা হোক করে তো একে রাখা যাবে না। কোথায় রাখি এই সম্পদ?
ফুটদেড়েক লম্বা। হালকা পাতলা ফিনফিনে কাঁচের ফুলদানি। নিচের দিক থেকে একটা সোনালী কোমল হাত যেন একটি ঘোলাটে সাদা পাত্রের ধাত্রী। সেই পাত্রের মধ্যে থাকবে রঙবেরঙের প্রজাপতির মতো ফুল। সরু লম্বাটে মেহগনি কাঠের টেবিলে বিছানো থাকবে হাতে বোনা, নিখুঁত নকশা করা রেশমি কাপড়। তার ওপর থাকবে এই দৃষ্টি নন্দন দুষ্প্রাপ্য বেলজিয়াম ফুলদানি।
আমি কী বলছি, বুঝতে পারছ বৌমা?
বৌমার হাতে ঐতিহ্যের প্রতীক। বেলজিয়াম ফুলদানি। চাপ দিতেও বুক কাঁপছে। মড়মড় করে গুঁড়িয়ে যায় যদি। এতো শুধু ফুলদানি নয়। স্নেহ, বিশ্বাস আস্থার আধার।
গুঁড়িয়ে গেলে ঐ সরলতায় ভরা বৃদ্ধার হৃদয়ে চিড় ধরবে। এমন নিষ্ঠুরতা, না না। অসম্ভব।
সেই থেকে আছে। শোকেসে। ফুলদানিতে ফুল সাজাবার বাহারী কৌলিন্য এখন অস্তমিত। তাই তার পাকাপোক্ত ঠাঁই, শোকেস। স্মৃতি। মায়াময় ভালবাসার চিহ্ন।
বৌমা এখন শাশুড়ি। কালের নিয়মে। ছেলে আর ছেলের বউ, কর্পোরেট হাউসের উচ্চ পদাধিকারী। ঘরের সঙ্গে সম্পর্ক বলতে, রাতের বেডরুম আর সকালের বাথরুম।
কখনো সখনো লাঞ্চ কিংবা ডিনার। কেমন যেন বুড়ি ছোঁয়া গোছের ব্যাপার। আছি আবার নেইও।
পরিচিত মুখ, অপরিচিত সম্পর্ক। চেনা তবুও অচেনা। বিস্তর ফাঁক। কেমন যেন আড়ি আড়ি, ভাব ভাব খেলা। কথাবার্তার আদান-প্রদান মাপা। প্রয়োজন ভিত্তিক। নিষ্প্রাণ। আন্তরিকতাহীন কর্তব্যের দায় সারা। এক ছাদের তলায় সময়ের রুদ্ধশ্বাস জীবন যাপন।আ স্থা বিশ্বাস ভালবাসার ফুলহীন ফুলদানি, দমবন্ধ শোকেসে আটক।
সেদিন, একাকীত্বের নির্মম ঘুমহীন গভীর রাতে, মানবী, নরম বিছানার সুদৃশ্য পালঙ্কে নির্বাক, স্থির তাকিয়ে ছিল সেই প্রাচীন ফুলদানিটির দিকে। শাশুড়ীমা’য়ের শাশুড়ী থেকে মানবী।
অনেক পথ, অনেক সময়। এবার থেমে যাবার সময়। পুরাতন বিশ্বাস, আস্থা, ভালবাসার বুঝি এখানেই সমাপ্তি।
মানবী, খুব সন্তর্পণে, পরম আদরে, ফুলদানি খানি তুলে নিল হাতে। অনেক অনেক অনেকদিন পরে, মানবীর স্পর্শে যেন ঘুম ভাঙলো তার। আঁচলের প্রান্ত বুলিয়ে যেন স্নেহ মাখিয়ে দিচ্ছিল তাকে মানবী।
এইতো সেই সোনালী কোমল হাত। এইতো সেই ঘোলাটে সাদা রঙের পাত্র। না না.. কোথাও কোনও মলিনতা নেই। এতটুকুও ধূসর বিষণ্ণ হয়নি উজ্জ্বলতা। মানবীর বুক ভাঙা দীর্ঘশ্বাস।
রঙ হারিয়েছে মন। উজ্জ্বলতা খুইয়েছে পরিবেশ। অন্ধকারে ঢেকেছে পরিস্থিতি।
দু’হাতে স্মৃতি পিছুটানকে বুকে জাপটে ধরে, কাঁপন ধরা ঠোঁটে, ভিজে চোখে, ধীরে ধীরে বসে পড়লো পালঙ্কে।
ঠিক তখনই যেন, ঐতিহ্য, ফিসফিস করে বললো- মানবী কাঁদো, আরও কাঁদো। কিন্তু সাবধান। যেন শব্দ না হয়। নবজন্ম পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছে। ব্যাঘাত না হয়।
সেই গভীর অন্ধকার বেয়ে, কে জানে, কোন সে অচিন দূর থেকে ভেসে আসছিল একটা সুর।
বাঁশি.. বাঁশি.. তোমায় দিয়ে যাবো কাহার হাতে…
আমার রাত পোহালো।
আমার সকল শুভানুধ্যায়ী বন্ধুদের এই লেখাটি পড়তে অনুরোধ করছি ।
বাহ, বড় সুন্দর ……